
শহীদ রায়হান। চলচ্চিত্র নির্মাতা।
আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি—একটি নদীমাতৃক দেশ থেকে, যেখানে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার ভাঙন ও গড়নের ভেতর দিয়েই মানুষ জন্ম নেয়, বাঁচে, আবার বিলীন হয়ে যায়। শৈশবে আমার চোখের সামনে নদীর ধারে ঘরবাড়ি এক রাতেই ভেঙে গেছে, জমি নদীতে মিলিয়ে গেছে, আবার কোথাও হঠাৎ করে নতুন চর জেগে উঠেছে। নদীর কাছে আমরা শিখেছি, কিছুই স্থায়ী নয়, প্রতিটি জন্মের ভেতর লুকিয়ে আছে বিলয়, আর প্রতিটি বিলয়ের ভেতর লুকিয়ে আছে নতুন জন্ম। আমি চলচ্চিত্র নির্মাতা, আর আমার চোখ সবসময় গল্প খোঁজে—কখনো মানুষের মুখে, কখনো নদীর বুকে, কখনো আলো-ছায়ার খেলায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার উত্তরে, কোকোনিনো ও মোহাভে কাউন্টির বিশাল প্রান্তরে দাঁড়িয়ে যখন প্রথমবার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখলাম, মনে হলো আমি পৃথিবীর আদি সিনেমার দর্শক হয়ে গেছি। এখানে পরিচালক প্রকৃতি নিজে, আর আমি কেবল বিস্ময়ে নির্বাক এক দর্শক।
সামনে প্রসারিত সেই দৃশ্যপট এক অদ্ভুত স্তব্ধতা ছড়িয়ে দিল। আমার মনে হলো, আকাশ থেকে যদি পৃথিবীর বুকের ভাঁজ দেখা যেত, তবে এর চেয়ে স্পষ্ট কোনো ছবি থাকত না। প্রায় ৪৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ, কোথাও আধা কিলোমিটার, কোথাও ত্রিশ কিলোমিটার প্রশস্ত, গড়ে এক মাইল গভীর এই গিরিখাত পৃথিবীর বুকের ক্ষতচিহ্নের মতো প্রসারিত। কিন্তু এই ক্ষত কোনো ধ্বংস নয়, বরং কোটি বছরের সৃষ্টির কাহিনি। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শিলাস্তরের গায়ে সোনালি আভা পড়ল, দুপুরে সেই একই প্রাচীর লাল আগুনে দীপ্ত হলো, আর সন্ধ্যায় সব বেগুনি-নীল ছায়ায় ঢেকে গেল। মনে হলো দিনের ভেতর এক নাটক অভিনীত হচ্ছে—তিন অঙ্কের নাটক, যেখানে রঙ আর আলো চরিত্র হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই নাটকের পেছনে জমে আছে কোটি বছরের মহাকাব্য, যা চোখে দেখা যায় না, কেবল অনুভূত হয়।
গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস পৃথিবীর নিজের জীবনী। উপরের স্তরে আছে কাইবাব লাইমস্টোন—প্রায় ২৬০ মিলিয়ন বছর পুরোনো, একসময়ের অগভীর সমুদ্রের তলদেশ। সেই স্তরে আজও দেখা যায় সামুদ্রিক প্রাণীর জীবাশ্ম—প্রবাল, শামুক, কেঁচো। তার নিচে আছে টোরোভাইপ ফরমেশন, রেডওয়াল লাইমস্টোন, মুয়াভ লাইমস্টোন, ব্রাইট এঞ্জেল শেল—যাদের ভেতর একেকটি যুগের সাগর, মরুভূমি আর জলাভূমির স্মৃতি জমা আছে। রেডওয়ালের গাঢ় লাল রঙ দূর থেকে চোখে পড়ে, আর ব্রাইট এঞ্জেলের শেলের ভেতর লুকিয়ে আছে প্রাচীন জলের ছাপ। আরও নিচে নামলে চোখে পড়ে ভিসনু স্কিস্ট ও অন্যান্য প্রাচীন শিলা, যাদের বয়স এক বিলিয়ন বছরেরও বেশি। পৃথিবীর আদি ইতিহাসের আগুন, সাগরের চাপ, ভূত্বকের আন্দোলন—সব মিলিয়ে এখানে লেখা আছে পৃথিবীর প্রথম অধ্যায়। প্রতিটি স্তর একেকটি হারানো সময়, যেন ইতিহাসের পাতা একে একে উল্টে যাচ্ছে।
এই স্তরগুলোকে দৃশ্যমান করেছে কলোরাডো নদী। প্রায় পাঁচ থেকে ছয় মিলিয়ন বছর আগে নদী মালভূমিকে কেটে নিজের পথ তৈরি করতে শুরু করে। গড়ে তিনশো ফুট প্রস্থ নদীটি প্রতি মাইলে সাত ফুট ঢাল নিয়ে গর্জন করে চলে, আর সেই গর্জনের ধারাবাহিকতাই কেটে কেটে বানিয়েছে এই অতল গিরিখাত। নদীর কাজ যেন এক ভাস্করের কাজ। আমাদের দেশে নদী এক রাতে গ্রাম ভাসিয়ে নেয়, জমি খেয়ে ফেলে। এখানে সেই একই প্রক্রিয়া চলছে, তবে মহাজাগতিক ধৈর্যে। কোটি বছরের ভাঙন-গড়ন একসাথে মিলেমিশে তৈরি করেছে পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য এই দৃশ্য।
কিন্তু গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন শুধু পাথরের বই নয়, এটি মানুষের আত্মারও গ্রন্থ। হাজার হাজার বছর ধরে এখানে বসবাস করছে নেটিভ আমেরিকান উপজাতি। হাভাসুপাই, হোপি, হুয়ালাপাই, নাভাহো, পাইউট, জু́নি, যাভাপাই-অ্যাপাচি—কমপক্ষে এগারোটি উপজাতি নিজেদের এই ভূমির সন্তান মনে করে। তাদের কাছে ক্যানিয়ন কেবল একটি স্থান নয়, এটি সৃষ্টি ও জীবনের প্রতীক।
হাভাসুপাইরা নিজেদের বলে “নীল-সবুজ জলের মানুষ”, কারণ তাদের হাভাসু ক্রিকের জলপ্রপাত আজও নীলাভ আভায় ঝরে পড়ে। তারা বিশ্বাস করে এই জলই তাদের আত্মা। হোপিদের মিথে বলা হয়, মানুষ ভূগর্ভের এক সিপাপু থেকে উঠে এসে পৃথিবীতে প্রবেশ করেছে, আর গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন সেই জন্মপথের স্মারক। নাভাহোরা মনে করে, ক্যানিয়ন তাদের চারটি পবিত্র পর্বতের একটি অংশ। জু́নিরা এটিকে তাদের পূর্বপুরুষের ভ্রমণপথ হিসেবে দেখে। এই উপজাতিদের প্রতিটি গান, প্রতিটি আচার, প্রতিটি উৎসব ক্যানিয়নের সাথে যুক্ত।
এই গল্পগুলো শুনতে শুনতে আমার মনে পড়ল বাংলাদেশের ভাটিয়ালি। আমাদের জেলেরা নদীর বুকে গান গায়, তাদের সুরে মিশে থাকে নদীর স্রোতের শব্দ। তেমনি হোপি বা হাভাসুপাইরা ক্যানিয়নের বুকে গান গায়, তাদের সুরে মিশে থাকে প্রাচীরের প্রতিধ্বনি। ভিন্ন মহাদেশ, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন ইতিহাস, কিন্তু মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক সর্বত্র একই।
গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ইউরোপীয় চোখে প্রথম ধরা পড়ে ১৫৪০ সালে, স্প্যানিশ অভিযাত্রী গার্সিয়া লোপেজ দে কার্দেনাসের চোখে। কিন্তু তিনি এই গভীরতার আসল মাপই বুঝতে পারেননি। উনবিংশ শতকে জন ওয়েসলি পাওয়েল ছোট নৌকায় কলোরাডো নদী বেয়ে যাত্রা করে এর মানচিত্র আঁকলেন। তাঁর অভিযাত্রা শুধু মানচিত্র পূর্ণ করল না, মানুষের কল্পনায়ও নতুন দিগন্ত খুলে দিল। পরে রেললাইন এলো, লজ তৈরি হলো, পর্যটক আসতে শুরু করল। ১৯১৯ সালে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্ক হিসেবে ঘোষণা পেল, আর ১৯৭৯ সালে ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত হলো। আজ এটি পৃথিবীর অন্যতম সুরক্ষিত ও জনপ্রিয় নিদর্শন।
কিন্তু জনপ্রিয়তার সাথে এসেছে নতুন সমস্যা। ২০২৪ সালে এখানে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন মানুষ ভ্রমণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সব জাতীয় উদ্যানে ভ্রমণ করেছে প্রায় ৩৩২ মিলিয়ন মানুষ। মানুষের পদচিহ্ন যেমন বিস্ময়ের সাক্ষ্য দেয়, তেমনি হুমকিও বয়ে আনে। অতিরিক্ত ভিড়, আবর্জনা, জলবায়ুর পরিবর্তন, আর বন্যাগ্নি ক্যানিয়নের ভারসাম্যকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। ২০২৫ সালের গ্রীষ্মে উত্তর প্রান্তের ঐতিহাসিক লজ বন্যাগ্নিতে ক্ষতিগ্রস্ত হলো, ফলে পুরো নর্থ রিম বন্ধ রাখতে হলো। প্রকৃতি যেন বারবার মনে করিয়ে দেয়, তার সৌন্দর্য ভোগ করা যায়, কিন্তু অবহেলা করলে সে প্রতিবাদ করে।
আমি সারাদিন হাঁটলাম সাউথ রিমের মাতার পয়েন্ট, ইয়াভাপাই জিওলজি মিউজিয়াম, ডেজার্ট ভিউ টাওয়ার, হেরমিটস রেস্ট। প্রতিটি ভিউপয়েন্টে আলো বদলালো, দৃশ্য বদলালো। ভোরের সোনালি আভা থেকে দুপুরের তীব্র লাল, আর সন্ধ্যার বেগুনি ছায়া—প্রতিটি মুহূর্তে মনে হলো আমি এক বিশাল সিনেমার ভেতরে আছি। কিন্তু এই সিনেমার পরিচালক কোনো মানুষ নয়, প্রকৃতি নিজে। আমি কেবল সহকারী, ক্যামেরা চালিয়ে তার অল্প কিছু মুহূর্ত ধরে রাখার চেষ্টা করি।
বাংলাদেশের কথা মনে পড়ল। পদ্মার ধারে ভাটিয়ালি গাইতে গাইতে জেলের নৌকা ভেসে যাচ্ছে, নদী ভাঙছে, নতুন চর উঠছে। আমাদের দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন—সোনারগাঁও, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়—সবই প্রকৃতির হাতে লেখা ইতিহাসের পাতার মতো। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন সেই একই ইতিহাসের মহাকাব্য, শুধু আকারে বিশাল।
এই ভ্রমণ আমাকে শিখিয়েছে—মানুষ ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু প্রকৃতি ধৈর্যশীল। সভ্যতা বারবার গড়ে উঠে, আবার ধ্বংস হয়। কিন্তু প্রকৃতি কোটি বছরের ধৈর্যে তার কাহিনি চালিয়ে যায়। চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আমার কাছে এই শিক্ষা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি ফ্রেম যদি ধৈর্যের সঙ্গে দেখা হয়, প্রতিটি দৃশ্য যদি সময়ের গভীরতা নিয়ে ধারণ করা হয়, তবে সেটিও ইতিহাস হয়ে দাঁড়ায়।
ফিরে আসার সময় আমার মনে হলো, আমি কেবল কিছু ছবি ধারণ করিনি, বরং প্রকৃতির সঙ্গে এক অন্তহীন সংলাপে অংশ নিয়েছি। আমি শিখেছি, ইতিহাসকে শুধু বইয়ে নয়, শিলাস্তরে, নদীর বাঁকে, আলো-ছায়ার খেলায় পড়তে হয়। আর বিস্ময়ের চোখ খোলা রাখতে হয়, কারণ বিস্ময়ই প্রকৃত জ্ঞান। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন আমাকে মনে করিয়ে দিল—তথ্য ও আবেগ, বিজ্ঞান ও কবিতা, ইতিহাস ও মিথ—সব মিলেই গড়ে ওঠে পৃথিবীর মহাগ্রন্থ। আমরা কেবল সেই মহাগ্রন্থের এক মুহূর্তের পাঠক।