ঢাকা | , ১২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আন্তরিক মানুষ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

Staff Reporter
নিউজ প্রকাশের তারিখ : Oct 20, 2025 ইং
ছবির ক্যাপশন: ছবির ক্যাপশন:
ad728

শাহনাজ মুন্নী :: কবি ও কথাসাহিত্যিক
যদ্দুর মনে পড়ে, আরও অনেকের মতো সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের লেখার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে ছাপা শিল্প-সাহিত্যবিষয়ক কলাম ‘অলস দিনের হাওয়া’ পাঠের মাধ্যমে। তারপর নব্বইয়ের দশকে, যখন আমরা নবীন লেখক তখন তার নাম আরও আলোচিত হয়েছে, যখন তিনি ব্রাত্য রাইসুর সঙ্গে যৌথভাবে ‘যোগাযোগের গভীর সমস্যা নিয়ে কয়েকজন একা একা লোক’ উপন্যাস লিখতে শুরু করলেন। কেউ কেউ ছ্যা ছ্যা করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্বনামধন্য শিক্ষক হয়ে কীভাবে তিনি রাইসুর মতো ‘ছন্নছাড়া’ তরুণের সঙ্গে এমন একটা লেখা শুরু করতে পারলেন? কেউ কেউ আবার একে ইতিবাচকভাবেও নিলেন। বললেন, নাক উঁচু প্রবীণদের তথাকথিত গাম্ভীর্য ভেঙে দিয়ে সৈয়দ মনজুর প্রথাবিরোধী সংস্কৃতি নির্মাণ করতে চাইছেন। মোটকথা, পাঠক ও বোদ্ধা মহলে বিষয়টি তখন বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ হয়ছে অনেক পরে। এর আগে তার কিছু ছোটগল্প পড়েছি ছাড়া ছাড়াভাবে। দেখেছি, উনার গল্পের বিষয়বস্তু বিচিত্র। মনে হয়েছে, কথকের ভঙ্গিতে তিনি সুন্দর করে গল্প বলেন। সমালোচকরা তার গল্পে জাদুবাস্তবতার ছোঁয়াও খুঁজে পেয়েছেন। আমাদের মনে হতো, তিনি আলাদা রকমের গল্প লিখতে চান। সময় এবং সমাজের খণ্ড খণ্ড চিত্র তার গল্পে চমৎকারভাবে উঠে আসত। ১৯৯৬ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলেন। ২০০৫ সালে প্রথম আলো বর্ষসেরা বই হিসেবে পুরস্কৃত হলো তার গল্পগ্রন্থ। সমকালীন বাংলা সাহিত্যের প্রধান গল্পকারদের একজন হিসেবে সবাই সমীহের সঙ্গে তার নাম উচ্চারণ করতে শুরু করল। বলতে গেলে তিনি তখন সেলিব্রিটি। একে তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের কীর্তিমান অধ্যাপক, অন্যদিকে টেলিভিশন ও বিভিন্ন সাহিত্য অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে তিনি উজ্জ্বল মুখ। কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, চিত্র সমালোচকÑ এমন নানা পরিচয়ে তিনি অনন্য।
আমার ঠিক মনে নেই করে কীভাবে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারের সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি পরিচয় হলো। তবে সেটা আমার কাজের সূত্রে সংবাদের জন্য ইন্টারভিউ নিতে গিয়েই হবে হয়তো। অন্যের প্রশংসা করতে তিনি সর্বদাই অত্যন্ত উদার। সিনিয়ররা যেখানে সহজে জুনিয়রদের পাত্তা দিতে চান না, সেখানে তিনি তরুণদের লেখা আগ্রহ করে পড়তেন ও উৎসাহ দিতেন সব সময়। মনে পড়ে, প্রথম দেখাতেই আমাকে চমকে দিয়ে স্মিতহাস্যে বললেন,
‘তোমার লেখা গল্প তো পড়েছি। খুব ভালো।’
তারপর বহুবার স্যারের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে। দেখেছি, তার শান্ত শ্রী ও স্নেহপ্রবণ চেহারা। খুব জমিয়ে গল্প করতে পারতেন তিনি। তার আড্ডায় উচ্চমানের রসরোধ থাকত, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ঝিলিক থাকত, সমসাময়িক বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের বিশ্লেষণ থাকত, পাশাপাশি সহমর্মিতা ও প্রাণখোলা হাসিও থাকত।
বহুবার তিনি আমার কর্মস্থল নিউজ টোয়েন্টিফোরে গেছেন টক শো’র অতিথি হয়ে। অনুষ্ঠান শুরুর আগে নঈম নিজাম ভাই, ইমদাদুল হক মিলন ভাই, আমিসহ অন্যান্য সহকর্মীর সঙ্গে লাগাতার গল্প চলেছে। একবার চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম কোনো একটা ওয়ার্কশপে যোগ দেওয়ার জন্য। এয়ারপোর্টে স্যারের সঙ্গে দেখা। তিনিও যাচ্ছেন কোনো একটা কাজে। স্যার পিতৃসম দায়িত্বশীলতায় আমার খোঁজখবর রাখলেন সারাটা সময়।
তিনি আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না, কিন্তু তিনি ছিলেন আমাদের মতো অনেকের দিশারি হয়ে। সাহিত্যজগতে এমন ব্যক্তিত্ব বিরল। সে কারণেই তার মৃত্যু সাহিত্য ও শিক্ষাঙ্গনে অপরিসীম শূন্যতা সৃষ্টি করেছে।
অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন তীক্ষèধীসম্পন্ন চিন্তাবিদ। তার শেষ বক্তৃতায় শিক্ষকদের প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘শিক্ষককে ভালো হতে হবে। শিক্ষককে মেধাবী হতে হবে। আমাদের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা কত বেতন পান? সংস্কার তো ওইখান থেকেই শুরু করতে হবে। বেতন তো বাড়া উচিত প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের! এই বর্তমান বাজারে তাদের যদি দেওয়া হয় এক লক্ষ টাকা করে মাসে, তাদের থাকার জায়গা দেওয়া হয় মানসম্পন্ন, বিসিএস পরীক্ষার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করার চাইতে এই মেধাবীরা প্রাইমারি স্কুলে এসে ঢুকবে। আপনি ভাবুন, কত বড় একটা বিপ্লব হতে পারে শিক্ষার ক্ষেত্রে!’
সমাজের অবক্ষয় প্রসঙ্গে তার ভাষ্য, ‘আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, দ্বন্দ্বমান সমাজে সব সময় পক্ষ-প্রতিপক্ষ থাকে। পক্ষের দিকে যদি আমরা থাকি, যেখানে শুভ আছে, সুন্দর আছে, কল্যাণ আছে, তাহলে বাকিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু আমরা তো ওইদিকে চলে যাই। আমরা অকল্যাণ দেখলেই দৌড়ে পড়ি। অশুভ দেখলেই আমাদের আনন্দ হয়। বীভৎসতা-সহিংসতা আমাদের এত বেশি তৃপ্তি দেয়! একজন নিরীহ মানুষকে ধরে আমরা যেকোনো ধরনের অন্যায় করতে পারি তার সঙ্গে। তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারি। একজন নারীর নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ আমরা প্রতিষ্ঠা করতে কখনও দেব না। তাদেরকে সব সময় একদম এক ধরনের মোর‌্যাল পুলিশিংয়ের ভেতর রাখব।’
হতাশা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘কেউ শোনেননি কথা। আমি বহুদিন থেকে লেখালেখি করছি। কেউ একটা কথাও শোনেননি। সংস্কার হবে কী করে? যারা সংস্কার করবেন, তাদেরও তো শিক্ষার অভাব আছে।’
সর্বশেষ ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে তিনি এসেছিলেন সোনারগাঁয়ের নয়াপুরে আমাদের প্রশান্তিবাড়িতে। হাতে করে শুভেচ্ছার স্মারক হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন ফুলের তোড়া। তারপর তো চার-পাঁচ ঘণ্টা ভারি আনন্দে আমাদের সময় কেটেছিল। ছবি তুলে, গল্পে, আড্ডায়, হাসিতে স্যার মাতিয়ে রেখেছিলেন পুরোটা সময়।
আমরা মনে করি, তার এই প্রয়াণ দেহত্যাগমাত্র। তিনি আছেন, তিনি থাকবেন। তার প্রজ্ঞাসঞ্জাত বিপুল সৃজনশীল-মননশীল কাজ বহু কাল ধরে এই দেশে তিমিরবিনাশী আলোর মশাল হয়ে জ্বলবে। 

নিউজটি পোস্ট করেছেন : Staff Reporter

কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ