দেশের ব্যাংক খাতে মূলধন ঘাটতির চিত্র দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। সর্বশেষ জুন প্রান্তিকের তথ্য বলছে, ৬১টি তফসিলি ব্যাংকের মধ্যে ২৪টি ব্যাংক মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। এসব ব্যাংকের সম্মিলিত মূলধন ঘাটতি দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ তালিকায় রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি, বিশেষায়িত দুটি ও বেসরকারি ১৮টি ব্যাংক রয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই দীর্ঘদিন ধরে খেলাপি ঋণের ভয়াবহ চাপের মধ্যে রয়েছে এবং প্রতি প্রান্তিকেই তা বাড়ছে। আর খেলাপি ঋণ বাড়ায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে পারছে না। ফলে মূলধন হারিয়ে ফেলছে ব্যাংকগুলো। এ পরিস্থিতি শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর জন্য নয়, সার্বিক আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার জন্য বড় উদ্বেগের বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
কোনো ব্যাংকের মূলধন হলো তার আর্থিক ভিত্তির মাপকাঠি। যেসব ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে থাকে, সেগুলো শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ প্রদান করতে পারে না। আবার অন্য দেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে সেগুলোকে অসুবিধায় পড়তে হয়। খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানা অনিয়ম ও লুটপাটের মাধ্যমে যেসব ঋণ বের করে নেওয়া হয়েছিল, পটপরিবর্তনের পর তা খেলাপি হিসেবে প্রদর্শন করা শুরু করেছে ব্যাংকগুলো। এতে গত কয়েক প্রান্তিকে রেকর্ড পরিমাণ খেলাপি ঋণ বেড়েছে। আর খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। এর বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বাড়লেও নিয়ম মেনে অনেক ব্যাংকই তা সংরক্ষণ করতে পারছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, তফসিলি ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম চালানোর জন্য ন্যূনতম রক্ষিতব্য মূলধন (এমসিআর) ও ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফার (সিসিবি) থাকতে হবে সেগুলোর মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০
শতাংশ ও আড়াই শতাংশ হারে। সেই সঙ্গে মূলধন ও দায়ের মধ্যে যথাযথ ভারসাম্য রক্ষায় ব্যাসেল-৩ কাঠামোর আলোকে ঝুঁকিভিত্তিক মূলধন পর্যাপ্ততার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে ২০১৫ সাল থেকে ন্যূনতম ৩ শতাংশ লিভারেজ অনুপাত (এলআর) সংরক্ষণ করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়, যা ২০২৩ সাল থেকে বাৎসরিক দশমিক ২৫ শতাংশ হারে ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে ২০২৬ সালে ৪ শতাংশে উন্নীত করার নির্দেশনা রয়েছে। তবে এসব নিয়ম মেনে গত জুন প্রান্তিকে অন্তত ২৪টি ব্যাংক মূলধন সংরক্ষণ করতে পারেনি। এ তালিকায় আছে রাষ্ট্রায়ত্ত তিনটি, বিশেষায়িত দুটি, বেসরকারি ২১টি ব্যাংক। আলোচ্য প্রান্তিকে নতুন করে এনআরবিসি ও আল-আরাফাহ্? ইসলামী ব্যাংক ঘাটতিতে পড়েছে। এসব ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। গত মার্চ শেষে ২৩ ব্যাংকের ঘাটতি ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ২৬০ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ে সর্বোচ্চ মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে বিশেষায়িত খাতের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। জুন শেষে ব্যাংকটির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। একই সময়ে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি দাঁড়িয়েছে জনতা ব্যাংকের। জুন শেষে এই ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১৭ হাজার ২৫ কোটি টাকা। এরপর অগ্রণী ব্যাংকের ৭ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ৪ হাজার ১৭৩ কোটি এবং বেসিক ব্যাংক ৩ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকার ঘাটতিতে পড়েছে।
বেসরকারি খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি ন্যাশনাল ব্যাংকের। জুন শেষে এটির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের ব্যাংকের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘাটতি এবি ব্যাংকের, যার পরিমাণ ৬ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। তৃতীয় থাকা পদ্মা ব্যাংকের ৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া আইএফআইসি ব্যাংক ৪ হাজার ৫১ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ১ হাজার ৮৭৮ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ১ হাজার ৬৪০ কোটি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ১ হাজার ৩৮৫ কোটি, এনআরবিসি ব্যাংকের ৩১৬ কোটি, সিটিজেন ব্যাংকের ৮৬ কোটি ও সীমান্ত ব্যাংক ৪৫ কোটি টাকা ঘাটতিতে পড়েছে।
শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতি ইউনিয়ন ব্যাংকের। জুন শেষে এই ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘাটতি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের; এই ব্যাংকের ঘাটতি ১৮ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। তৃতীয় সর্বোচ্চ ঘাটতি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ১০ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। এ ছাড়া গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ঘাটতি ৫ হাজার ৫৫২ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ২ হাজার ৭৯ কোটি, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ১ হাজার ৯৭৫ কোটি, এক্সিম ব্যাংকের ৯০১ কোটি এবং আল-আরাফাহ্ ব্যাংকের ২৫৪ কোটি টাকা।
নিউজটি পোস্ট করেছেন :
Staff Reporter